সাম্যের লড়াইয়ে মহানায়ক
“আমাদের বিদ্রোহ- অমানিশা পার হতে আলোকের পথে… মুক্তির যাত্রায় এ পথ আমার বুঝি শেষ হবার নয়।”
এই পংক্তি একজন কালো মানুষের, স্বাধীনতাকামী এক আজন্ম নেতার, যার ৯৫ বছরের জীবন ছিল সাদা-কালোর তফাৎ ঘুঁচিয়ে সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অন্য নাম।
এই লড়াইয়ে নিজেকে উৎসর্গ করেই নেলসন ম্যান্ডেলা হয়ে ওঠেন বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার প্রতীক, এ কালের ‘মহানায়ক’। তার হাত ধরেই স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল দক্ষিণ-আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠরা।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ ম্যান্ডেলা বৃহস্পতিবার জোহানেসবার্গে তার নিজের বাড়িতে মারা গেছেন।
নির্দিষ্ট কোনো স্থান বা কালে সীমাবদ্ধ থাকেনি ম্যান্ডেলার সংগ্রাম। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্নের কথা তিনি বলেছিলেন, তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের কোটি মানুষের হৃদয়ে।
তার এ সংগ্রাম বিশেষ কোনো বর্ণ বা গোত্রের বিরুদ্ধে নয়, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে আধিপত্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তিনি।
ম্যান্ডেলার ভাষায়, “বর্ণবাদকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি, কেননা আমি একে বর্বরোচিত মনে করি, সেটা কৃষ্ণাঙ্গ বা শ্বেতাঙ্গ যাদের কাছ থেকেই আসুক।”
শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ম্যান্ডেলার। ২৭ বছর বন্দিত্বের পর ১৯৯০ সালে মুক্ত হন। এর চার বছর পর জনগণের ভোটে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হন তিনি। সেখানেই শেষ নয়- দেশের বাইরে অন্যান্য সংঘাতময় এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও তিনি এগিয়ে আসেন।
গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ম্যান্ডেলার নেতৃত্বকে সম্মান জানাতে ১৯৯৩ সালে তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয় বিশ্ব সম্প্রদায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ১৯৯৭ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশেও এসেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা।
১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার পর প্রচারে নামেন মরণব্যাধী এইচআইভি/এইডসের বিরুদ্ধে, যা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছিল আফ্রিকার দেশগুলোতে। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা ছিল বলে ধারণা করা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অসুস্থতা জেঁকে বসলেও ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, বুরুন্ডিসহ আফ্রিকার সংঘাতময় দেশগুলোতে শান্তি আলোচনায় ছিলেন ম্যান্ডেলা।
৮৫ বছর বয়সে ২০০৪ সালে তিনি সব ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন।
পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাবেন জানিয়ে তিনি সে সময় বলেন, “আমাকে ডেকো না। আমি তোমাদের ডাকব।”
গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে যেতে হয় ম্যান্ডেলাকে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে জোহানেসবার্গের একটি হাসপাতালে ভর্তির পর প্রেসিডেন্ট দপ্তর থেকে জানানো হয়, আগে ফুসফুস সংক্রমণ হয়েছিল তার।
আশির দশকে রোবেন দ্বীপে বন্দি থাকার সময় যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ম্যান্ডেলা।
২০১২ সালের শুরুর দিকে ম্যান্ডেলা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে জানানো হয়, পাকস্থলীর সমস্যায় ভুগছেন তিনি। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফুসফুস সংক্রমণে বারবার চিকিৎসা নিতে হয় তাকে
১৯১৮ সালে দক্ষিণ অফ্রিকার ইস্টার্ন কেপের ছোট্ট এক গ্রামে যোসা ভাষিক টেম্বু গোত্রে ম্যান্ডেলার জন্ম। নিজের গোত্র থেকে পাওয়া ‘মাদিবা’ নামেও দেশবাসীর কাছে পরিচিত তিনি।
রোলিহ্লাহ্লা ডালিবুঙ্গা নামের কালো শিশুটি নেলসন ম্যান্ডেলা নামটি পান এক স্কুলশিক্ষকের কাছ থেকে, ওই নামেই ইতিহাস তাকে মনে রাখবে।
ম্যান্ডেলার বাবা ছিলেন ম্যটেম্বু গোত্রের ‘অভিজাত’ পরিবারের পরামর্শক। তিনি যখন মারা যান, ম্যান্ডেলার বয়স তখন নয় বছর। এরপর গোত্র প্রধানের তত্ত্বাবধানেই বেড়ে উঠতে থাকেন ম্যান্ডেলা।
১৯৪১ সালে ২৩ বছরের তরুণ ম্যান্ডেলার বিয়ের আয়োজন হয়। কিন্তু ঠিক তখনই সংসারে বাঁধা পড়ার ইচ্ছা তার ছিল না। ফলে বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে চলে যান জোহানেসবার্গে।
দুই বছর পর উইটসওয়াটারান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে ভর্তি হন ম্যান্ডেলা। সেখানেই বর্ণবাদ ও বৈষম্যের রূপ অনেক স্পষ্টভাবে দেখা হয় তার; পরিচয় ঘটে কট্টরপন্থা, উদারপন্থা ও আফ্রিকান ভাবনাগুলোর সঙ্গে।
ভবিষ্যতের বিশ্বনেতা ম্যান্ডেলার রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের শুরু ওই সময় থেকেই। ওই বছরই তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) যোগ দেন, গড়ে তোলেন তরুণদের শাখা- এএনসি ইয়ুথ লিগ।
১৯৪৪ সালে এভেলিন মাসের সঙ্গে বিয়ে হয় ম্যান্ডেলার। চার ছেলে-মেয়ে হওয়ার পর ১৯৫৮ সালে বিচ্ছেদ ঘটে তাদের।
এরই মধ্যে আইনজীবী সনদ পান ম্যান্ডেলা, ১৯৫২ সালে জোহানেসবার্গে অলিভার ট্যাম্বোর সঙ্গে যোগ দেন আইন পেশায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার শাসন ক্ষমতায় তখন সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গদের দল ন্যাশনাল পার্টি। তাদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই সোচ্চার হন ম্যান্ডেলা ও ট্যাম্বো। আইনি লড়াই চালিয়ে যান বর্ণবাদের বিরুদ্ধে।
১৯৫৬ সালে প্রথম মামলা হয় ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে। আরো ১৫৫ জনের সঙ্গে তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়। অবশ্য চার বছর পর মামলার রায়ে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পান তিনি।
ওই রায়ের পর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন নতুন গতি পায়। বিশেষ করে নতুন আইনে কালোদের বাসস্থান ও কাজ নির্দিষ্ট করে দেয়ায় শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
এরই মাঝে ১৯৫৮ সালে উইনি মাদিকিজেলাকে বিয়ে করেন ম্যান্ডেলা। ১৯৬০ সালে এএনসি নিষিদ্ধ করার পর আত্মগোপনে চলে যান তিনি।
একই বছর পুলিশের গুলিতে ৬৯ জন কৃষ্ণাঙ্গ নিহত হওয়ার পর সরকারবিরোধী ক্ষোভ তীব্রতর হয়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সরে আসে এএনসি। দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে হামলার সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর গ্রেপ্তার হন ম্যান্ডেলা, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে হামলা এবং সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে।
ওই মামলার শুনানিতে রিভোনিয়ার আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমতার দাবি তোলেন ম্যান্ডেলা।
“আমি একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের স্বপ্ন লালন করি, যেখানে সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সবাই সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করবে।
“এটাই আমার আদর্শ। আমি এটাই অর্জন করতে চাই। এর জন্য প্রয়োজন হলে আমি মরতেও প্রস্তুত।
১৯৬৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ম্যান্ডেলার। ১৯৬৮-৬৯ সালে ১২ মাসের ব্যবধানে মা ও বড় ছেলের মৃত্যু হয়। তাদের শেষকৃত্যে উপস্থিত হওয়ারও সুযোগ পাননি তিনি।
১৯৮২ সালে পোলসমুর কারাগারে নেয়ার আগে রোবেন দ্বীপে বন্দি জীবন কাটাতে হয় যৌবনের ১৮টি বছর।
ম্যান্ডেলা ও এএনসির জ্যেষ্ঠ নেতারা যখন অন্তরীণ, তখন সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলে দক্ষিণ আফ্রিকার তরুণরা। স্কুলশিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ দমন করতে সে সময় কয়েকশ’ তরুণকে হত্যা করে শাসকগোষ্ঠী। আহত হন কয়েক হাজার তরুণ।
১৯৮০ সালে ট্যাম্বোর নেতৃত্বাধীন এএনসি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচার শুরু করে। এক পর্যায়ে তাদের প্রথম ও প্রধান দাবি হয়ে ওঠে ম্যান্ডেলার মুক্তি।
১৯৮৮ সালে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে প্রায় ৭২ হাজার দর্শকের সামনে গাওয়া হয় ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা’ গানটি, টেলিভিশনের সামনে বসে যে গানে কণ্ঠ মেলান সারা বিশ্বের কোটি মানুষ।
জনমতের চাপে বিশ্ব নেতারা দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জোরদার করেন, যে নিষেধাজ্ঞা প্রথমে আরোপ করা হয়েছিল ১৯৬৭ সালে।
এরপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ জোরালো হয়ে উঠলে ১৯৯০ সালে এএনসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন দক্ষিণ আফ্রিকার তখনকার প্রেসিডেন্ট এফডব্লিউ ডি ক্লার্ক। কারাগার থেকে মুক্ত হন ম্যান্ডেলা। শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বহুদলীয় গণতন্ত্রের আলোচনা।
১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে ডি ক্লার্কের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ম্যান্ডেলা। এর পাঁচ মাস পর দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।
কারাজীবন থেকে ফেরার পর ১৯৯২ সালে দ্বিতীয় স্ত্রী উইনির সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালে ৮০তম জন্মদিনে ম্যান্ডেলা বিয়ে করেন মোজাম্বিকের প্রয়াত প্রেসিডেন্টের বিধবা স্ত্রী গ্রাসা ম্যাচেলকে।
১৯৯৯ সালে ডেপুটি থাবো এমবেকির হাতে ক্ষমতা ছাড়েন ম্যান্ডেলা। এরপর নিজের গড়ে তোলা ম্যান্ডেলা ফাউন্ডেশনের আওতায় জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
এ সময় বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং অন্য বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে বৈঠকেও তাকে অংশ নিতে দেখা যায়।
‘বিশ্বের বড় বড় সংকট’ নিরসনে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ৮৯ তম জন্মদিনে তিনি গড়ে তোলেন দ্য লিডার্স নামে একটি গ্রুপ।
ম্যান্ডেলার জীবনের শেষ জন্মদিনটি কাটে প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিনিক হার্ট হাসপাতালে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সেই দিনটি শুরু হয় লাখো স্কুলশিশুর কণ্ঠে 'হ্যাপি বার্থডে ম্যান্ডেলা' গানের মধ্য দিয়ে।
কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, বিশ্বের সব দেশের মানুষই প্রতি বছর তার জন্মদিন পালন করে যাবে। ম্যান্ডেলা নামের দীপ নিভে গেলেও তার ছড়ানো আলো অমানিশার কালো ছাড়িয়ে সাম্যের পথ দেখিয়ে যাবে মানুষকে।
আগামী পৃথিবীর শিশুরাও ম্যান্ডেলার সেই উদ্ধৃতি থেকে জীবনের পাঠ নেবে- স্বাধীনতার পথ কোথাও সহজ নয়। আকাঙ্ক্ষার পর্বতশীর্ষে পৌঁছানোর জন্য আমাদের বারবার অতিক্রম করতে হয় মৃত্যুর পথ।
[বিবিসি ও রয়টার্স অবলম্বনে]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন